গত পর্বে আমরা জেনেছিলাম মানুষের জন্য দেবতাদের কাছ থেকে আগুন চুরি করে আনায় প্রমিথিউসকে কি ভয়াবহ শাস্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিলো। জিউস কেবল প্রমিথিউসকে শাস্তি দিয়েই ক্ষান্ত হন নি, তিনি মানুষের জন্যও শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। কি ছিলো সেই শাস্তি? এ পর্বে সেটি নিয়েই আলোচনা করব। তাহলে শুরু করা যাক:
মানুষের জন্য দেবতাদের কাছ থেকে আগুন চুরি করার অপরাধে প্রমিথিউসকে জিউস ভয়াবহ শাস্তি প্রদান করেন। যাই হোক শাস্তি ভোগের আগে প্রমিথিউস তার ভাই এপিমিথিউসকে এই বলে সতর্ক করে দেন যে, সে যেন কখনো দেবতাদের কাছ থেকে কোন কিছু গ্রহণ না করে। প্রমিথিউস ভয় পাচ্ছিলেন, দেবতারা হয়তো কোন ছলনার আশ্রয় নিয়ে এপিমিথিউস অথবা পৃথিবীর মানুষদের কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে।
প্রমিথিউস এর ভয়টা অমূলক ছিলো না। জিউস সত্যি সত্যিই মানুষের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, প্রমিথিউসের কাছ থেকে আগুন নেওয়ার কারণে মানুষকেও যেন শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। তবে তিনি চাইছিলেন মানুষকে একটু অন্যভাবে শাস্তি দিতে। তিনি দেবতাদের আদেশ দিলেন এমন একজনকে তৈরি করতে, যে হবে অন্য সকল জীবের থেকে অনন্য। তাকে সুনিপুণভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব পড়লো দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ কারিগর হেপাস্টাসের উপর। হেপাস্টাস তার সৃষ্টিকে তৈরি করার জন্য মডেল হিসেবে বেছে নেন সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতিকে। হেপাস্টাসের হাতেই তৈরি হলো পৃথিবীর প্রথম মানবী প্যান্ডোরা। দেবদেবীরা তাদের সেরাটা দিয়ে প্যান্ডোরাকে সাজাতে বসে গেলেন। দেবী এথেনা তাকে শিখালেন নানা ধরণের শিল্পকলা। দেবতা হারমেস প্যান্ডোরাকে দান করলেন নারীসুলভ চপলতা, জেদ আর চতুরতা। অ্যাপোলো তাকে দান করলেন মোহনীয় কন্ঠ। আর হেরা প্যান্ডোরাকে দিলেন এমন এক জিনিস, যা ভবিষ্যতে কোন একদিন মানবজাতির সকল সর্বনাশের কারণ হবে- কৌতুহল। তাকে নানা ধরণের জাঁকজমক অলংকার ও পোশাকে সজ্জিত করা হলো। এরপর জিউস প্যান্ডোরাকে এপিমিথিউসের কাছে পাঠালেন উপহার হিসেবে।
যদিও প্রমিথিউস তার ভাই এপিমিথিউসকে বারবার করে নিষেধ করেছিলো জিউসের কাছ থেকে কোন উপহার না নিতে, তবুও এপিমিথিউস প্যান্ডোরার রূপে এতটাই অভিভূত হয়ে গেলেন যে,তিনি ভাইয়ের নিষেধের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন। এপিমিথিউস ভাবলেন, এত সুন্দর নারী কারো কোন ক্ষতি কিভাবে করতে পারে? তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন প্যান্ডোরাকে বিয়ে করবেন। যা ভাবা তাই কাজ। এপিমিথিউস আর প্যান্ডোরার মধ্যকার বিয়ে ধুমধাম করে সম্পন্ন হয়ে গেলো। বিয়ের অনুষ্ঠানে জিউস প্যান্ডোরাকে একটি বাক্স উপহার দিলেন। তবে জিউস প্যান্ডোরাকে বলে দিলেন কখনো যেন এ বাক্সটিকে না খোলা হয়। কিন্তু প্যান্ডোরাকে তৈরিই করা হয়েছিলো জগতের সবচেয়ে কৌতুহলী করে।বাক্সটি না খোলার নিষেধাজ্ঞাটা যেন তার কৌতুহলকে আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। প্রতিদিন সে বাক্সের কাছে যায়, আর চিন্তা করে বাক্সের ভিতর কি এমন থাকতে পারে, যেজন্য তাকে সেটা খুলতে নিষেধ করা হয়েছে! একদিন সে আর তার কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পেরে বাক্সটির ঢাকনা খুলেই ফেলে। কিন্তু হায়! বাক্সটিতে কোন উপহার ছিলো না। জিউস এ জগতের সকল অশুভ জিনিসগুলোকে একত্র করে বাক্সটিতে ভরে প্যান্ডোরাকে দিয়েছিলেন। বাক্সের মধ্যে থেকে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে সেইসব অশুভ শক্তিগুলো- লোভ, হিংসা, ঘৃণা, ব্যাথা, রোগ, ক্ষুধা, দারিদ্রতা, যুদ্ধ এবং মৃত্যু। সেই সমস্ত অশুভ জিনিস, যা ভবিষ্যতে পৃথিবীকেই চিরতরে পাল্টে ফেলবে। বলা যায় প্যান্ডোরার কৌতুহলই মানব জাতির সমস্ত দুঃখ কষ্টের সূচনাকারী। আর জিউস এইভাবেই মানব জাতিকে তার শাস্তি প্রদান করেন।
যাহোক, যখন বাক্স থেকে যখন সবকিছু বের হয়ে যাচ্ছিলো, তখন প্যান্ডোরা বুঝতে পেরেছিলো, সে কি বড় ভুল করে ফেলেছে। সাথে সাথে সে ঢাকনাটা আটকিয়ে ফেলে। কিন্তু ততক্ষণে প্রায় সমস্ত কিছুই বাক্স থেকে বের হয়ে গেছে। তবে ঢাকনা আটকিয়ে ফেলার ফলে শুধু একটিমাত্র জিনিস আর বের হতে পারে না৷ সে জিনিসটা হলো আশা। জিউস সকল খারাপ শক্তির সাথে আশাটাও বাক্সের ভিতর দিয়েছিলেন। আর প্যান্ডোরার বাক্সের ভিতর সেই আশাটা বন্দী হয়ে যায়। সেই থেকে মানুষ আশাটাকে পুঁজি করেই টিকে আছে। জগতের সকল অশুভ শক্তির সামনে মানুষ যখন অসহায় হয়ে পড়ে, তখন তার কাছে থাকা আশাটুকুই তাকে বেঁচে থাকার পথ দেখায়। এই আশাটাকেই আঁকড়ে ধরে মানুষ সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যায়।