গত পর্বে আমরা জেনেছিলাম গ্রীক মিথোলজিতে মহাবিশ্বের সৃষ্টির ইতিহাস ও বিখ্যাত টাইটান বনাম দেবতাদের মহাযুদ্ধ সম্পর্কে। আজকের পর্বে গ্রীক মিথোলজি অনুসারে মানুষ সৃষ্টি ও প্রমিথিউস সম্পর্কে আলোচনা করব। চলুন তাহলে শুরু করা যাক:
সৃষ্টির শুরুর দিককার কথা। টাইটান বনাম দেবতাদের মধ্যেকার মহাযুদ্ধটির অবশেষে পরিসমাপ্তি ঘটেছে। দীর্ঘ দশ বছর যুদ্ধের পর দেবতারা অবশেষে সেই যুদ্ধে বিজয় লাভ করে। যুদ্ধে পরাজিত টাইটানদের টারটারাসে (পাতালদেশে) বন্দি করা হয়। টাইটান হওয়া সত্ত্বেও এ মহাযুদ্ধে দেবতাদের পক্ষ নিয়েছিলেন প্রমিথিউস ও এপিমিথিউস নামে দুই ভাই। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, টাইটান হওয়া সত্ত্বেও কেন তারা দেবতাদের পক্ষে ছিলেন। আসলে প্রত্যেক টাইটানেরই নিজস্ব কিছু ক্ষমতা ছিলো। প্রমিথিউসের ক্ষমতা ছিলো, সে ভবিষ্যতে কি হবে তা সে অনুমান করতে পারত। এ মহাযুদ্ধে যে শেষ পর্যন্ত দেবতারাই বিজয়ী হবে সেটা সে আগেই অনুমান করতে পেরেছিলো। প্রমিথিউস বুঝতে পেরেছিলো, দেবতাদের সাথে থাকলে আখেরে তারই লাভ হবে। তাই সে ও তার ভাই এপিমিথিউস দেবতাদের পক্ষ নিয়ে লড়াই করে। ফলে তারা টারটারাসে বন্দী হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যান। প্রমিথিউস ও এপিমিথিউস দুজনই খুব ভালো কারিগর ছিলেন। তাই যুদ্ধের পর তাদেরকে এ জগতের জন্য নতুন প্রাণ সৃষ্টির দায়িত্ব দেওয়া হয়। নির্দেশমতো এপিমিথিউস মাটি ও পানির মিশ্রণে নানা ধরণের পশুপাখি সৃষ্টি করতে থাকে। কিন্তু প্রমিথিউসের চিন্তাভাবনা ছিলো আরো দূরদর্শী। সে এসব ছোটখাট পশুপাখি তৈরি করে সন্তুষ্ট হতে পারে নি। সে চেয়েছিলো এমন কিছু তৈরি করতে, যা হবে অন্য সকল জীবের থেকে অনন্য। তার ভাবনা মতো সে মাটি পানির মিশ্রন ব্যবহার করে দেবতাদের শারিরীক গঠনের অনুরূপ এক নতুন প্রজাতির সৃষ্টি করলো। যাদের সে নাম দিলো মানুষ।
মানুষ ও পশুপাখি তৈরির পর এপিমিথিউসের উপর দায়িত্ব এলো এগুলোর মধ্যে নানা ধরণের দক্ষতা, যেমন -গতি,শক্তি,ক্ষিপ্রতা ইত্যাদি বণ্টন করে দেওয়ার। এপিমিথিউস ছিলো আবার প্রমিথিউসের বিপরীত। তার মধ্যে প্রমিথিউসের দূরদর্শিতা আর ধূর্ততার কিছুই ছিলো না,বরং সে কোন কাজের আগেপিছে না ভেবেই কাজটা করে ফেলতো। স্বাভাবিকভাবেই সে অতশত বাছবিছার না করে সকল পশুপাখির মধ্যে ইচ্ছামত দক্ষতা বণ্টন করতে শুরু করলো। ফলে যখন মানুষকে দক্ষতা দেওয়ার সময় এলো তখন দেখা গেলো মানুষকে দেওয়ার মতো আর কোন দক্ষতাই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু প্রমিথিউস তার সেরা কাজকে এভাবে দক্ষতাবিহীন রাখতে চান নি। তাই তিনি দক্ষতার খোঁজে দেবতাদের প্রাসাদে গেলেন। দেবী এথেনা তখন প্রাসাদে ছিলো না। তাই প্রমিথিউস তার ঘরেই আগে ঢুকলেন। তার ঘরে প্রমিথিউস জ্ঞান আর যুক্তি নামের দুইটি দক্ষতা খুঁজে পান। প্রমিথিউস সেগুলোই চুরি করে এনে মানুষকে প্রদান করলেন। এভাবেই অন্যান্য পশুরা যেখানে পেলো শক্তি,দ্রুততা,ক্ষিপ্রতার মতো নানান ধরণের দক্ষতা, সেখানে মানুষ পেলো সবচেয়ে সেরা দক্ষতাটি,জ্ঞান।
মানুষ তৈরির পর জিউস শর্ত দিলো, তারা যেন সর্বদা দেবতাদের আরাধনা করে। তাদের জবাইকৃত পশুর একটা অংশ যেন দেবতাদের উদ্দেশ্যে সর্বদা উৎসর্গ করা হয়। কতটুকু মানুষের জন্য থাকবে আর কতটুকু দেবতাদের জন্য এই ভাগ বাটোয়ারার দায়িত্ব পান প্রমিথিউস। এটা ফয়সালার জন্য মিসোন নামক এক স্থানে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রমিথিউসকে দায়িত্ব দেওয়া হয় একটা ষাঁড়কে দুইভাগ করা। অনুষ্ঠানের দিন এই দুইভাগের মধ্যে যেকোনো একভাগ দেবতারা পছন্দমতো বাছাই করবে। এই অংশটি মানবজাতি কখনো খেতে পারবে না। তাদেরকে সর্বদা ওই অংশটি দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে হবে। বাকি যে ভাগটা থাকবে,মানুষ শুধু সেই ভাগটাই খেতে পারবে।
প্রমিথিউস তার সৃষ্ট মানুষ জাতিটিকে ভালবেসে ফেলেছিলো। তাই দেবতাদের এই অনর্থক ভাগ বাটোয়ারা তার পছন্দ হয় নি। মানুষ যেন তার ভাগে বেশি পায় এজন্য প্রমিথিউস কিছু কূটকৌশলের আশ্রয় নেন। প্রমিথিউস ষাঁড়ের হাড়গোড়কে একত্র করে সেটাকে সুন্দর সুন্দর চর্বি আর চামড়া দিয়ে ঢেকে একটা ভাগ তৈরি করেন। অন্যদিকে ষাঁড়ের মাংসগুলোকে একত্র করে সেটাকে নাড়িভুড়ি দিয়ে ঢেকে তৈরি করলেন আরেকটা ভাগ। মিসোনের সেই অনুষ্ঠানে প্রমিথিউস জিউসকে বললেন এই দুইটি ভাগ থেকে যেকোনো একটি বেছে নিতে। যেহেতু বাইরে থেকে দেখে চর্বি দিয়ে ঢাকা ভাগটাই সবচেয়ে সুন্দর দেখাচ্ছিলো, তাই জিউস সে ভাগটাই বেছে নিলেন। আর এভাবেই মানুষের ভাগে পড়লো ভালো মাংসের ভাগটুকু আর দেবতাদের ভাগে পড়লো হাড়ের ভাগটুকু। আর এভাবেই দেবতাদের প্রতি উৎসর্গের জন্য নির্ধারিত হয়ে গেল হাড়।
এরকম কান্ডের জন্য জিউসের প্রচন্ড মেজাজ গরম হয়ে গেলো। তিনি ঠিক করলেন, পৃথিবীতে কোন আগুনই রাখবেন না। জিউস পৃথিবী থেকে সমস্ত আগুন তুলে নেন। দেবতাদের এই নিষ্ঠুরতায় প্রমিথিউস অত্যন্ত মর্মাহত হন। তিনি ঠিক করেন, মানুষদের জন্য তিনি দেবতাদের কাছ থেকে আগুন চুরি করে আনবেন। কিন্তু আগুন মজুদ ছিলো
দেবতা হেপাস্টাসের কারখানায়। সেখান থেকে দেবতাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে আগুন আনা যায় তাই তিনি চিন্তা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রমিথিউসের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। তিনি স্বর্গের চত্বরে একটি সোনার আপেল রেখে এলেন। সাথে রেখে এলেন একটি নোট - সবচেয়ে সুন্দরী দেবীর জন্য। দেবীদের আর যাই থাকুক অহংকারের কোন অভাব ছিলো না। প্রত্যেক দেবীই নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী বলে মনে করত। তাই স্বভাবতই আপেলটি কার জন্য রাখা হয়েছিলো, তা নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়ে গেলো। দেবতারাও তাদের ঝগড়া উপভোগ করতে লাগলো। এই গন্ডগোলের সুযোগে প্রমিথিউস হেপাস্টাসের কারখানা থেকে আগুন চুরি করে আনেন।
এ ঘটনাটি পরে জানতে পেরে জিউস প্রচন্ডরকম ক্ষেপে গেলেন। ভাবলেন, অনেক হয়েছে, এবার প্রমিথিউসকে শাস্তি না দিলেই নয়। তিনি প্রমিথিউসের জন্য ব্যবস্থা করলেন এক ভয়াবহ শাস্তির। তাকে শিকল দিয়ে ককেশাস নামক এক পর্বতের সাথে বেঁধে রাখা হলো। জিউস ওখানে প্রতিদিন একটি ঈগলকে পাঠাতো। ঈগলটা প্রমিথিউসের কলিজা ঠুকরে খেয়ে ফেলতো। রাতের মধ্যে প্রমিথিউসের দেহে নতুন করে কলিজা তৈরি হতো। পরদিন সকালে আবার ঈগলটা একই কাজ করতো। জিউস এরকম ব্যবস্থা করে রেখেছিলো যেন প্রমিথিউস আজীবন শাস্তি ভোগ করতে থাকে। কেবল মানুষকে সাহায্য করার জন্যই প্রমিথিউসকে এ ভয়াবহ শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।
অনেক বছর যাবত এই শাস্তি ভোগ করার পর জিউসের ছেলে হারকিউলিসের হাতে অবশেষে প্রমিথিউসের মুক্তি ঘটে। হারকিউলিস ঈগলটিকে হত্যা করে এবং শিকল ভেঙ্গে প্রমিথিউসকে মুক্ত করে। জিউস প্রথমে প্রচন্ড রেগে গেলেও শেষ পর্যন্ত প্রমিথিউসের মুক্তি মেনে নেন। তবে শর্ত দেন প্রমিথিউসকে যে পাথরের সাথে বেঁধে রেখেছিলেন, সেই পাথরের একটি টুকরো শিকল দিয়ে সারাজীবনের জন্য তাকে আঙ্গুলের সাথে বেঁধে রাখতে হবে। অনেকটা আংটির মতো।কারো কারো মতে, এ কাহিনী থেকেই মূলত আংটি নামক গহনার উৎপত্তি হয়। প্রমিথিউসের এই আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতেই মানুষ আঙ্গুলে আংটি পড়ার প্রচলন শুরু করে।
[চলবে]