মিথোলজিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হিসেবে গ্রীক মিথোলজি কেই এগিয়ে রাখা হয়। জিউস, হারকিউলিস, মেডুসা, হাইড্রা - এদের গল্পগুলো আজও সমান জনপ্রিয় হয়ে মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। এত বছর পরেও সেই গল্পগুলোর আবেদন এতটুকুও কমেনি। এই গ্রীক মিথোলজি অনুসারে কেমন ছিল সৃষ্টি জগতের শুরু? আজকের লেখা সেসব নিয়েই। তাহলে শুরু করা যাক:
সৃষ্টির একদম শুরুর কথা। তখন পৃথিবী, আকাশ, পাতাল কিছুই সৃষ্টি হয় নি। অসীম এই মহাশূন্যতায় বিরাজ করতো কেবল ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন কুয়াশা। কুয়াশাঘেরা এই জগতটি কেওস নামে পরিচিত ছিলো। একসময় কেওসের এক অংশ ধীরে ধীরে জমাট বাঁধতে থাকে। এই জমাট বাঁধা অংশ থেকে এক সময় জন্ম নেয় গায়া, যাকে আজ আমরা পৃথিবী বলে চিনি। কেওস থেকে এরপর ধীরে ধীরে জন্ম নেয় টারটারাস (পাতালদেশ), এরেবাস (পরকালের অন্ধকার), নিক্স (পৃথিবীর অন্ধকার)। এরেবাস আর নিক্স পরস্পরের সাথে মিলিত হয়। তাদের মিলনে জন্ম নেয় ইথার (স্বর্গীয় আলো) আর হেমেরা (পৃথিবীর আলো)। এরপর নিক্স অন্য কারো সাহায্য ছাড়াই জন্ম দেয় মরোস (ভাগ্য), থানাটস(মৃত্যু), নেমেসিস (প্রতিশোধ) সহ আরো অনেক প্রাচীন সত্ত্বার।
এদিকে গায়াও বসে নেই। বিশ্বজগতটাতে সে বড়ই একা হয়ে পড়েছিলো। এই একাকিত্ব কাটাতে সেও কারো সাহায্য ছাড়াই জন্ম দেয় ইউরেনাস (আকাশ) এর। গায়া ইউরেনাসকে তার সঙ্গীর মর্যাদা দেয়। এরপর তাদের মিলনে জন্ম নেয় বারজন টাইটান, একচোখা দানব সাইক্লপস আর তিনশ হাতওয়ালা দানব হেকাটনচেরেস। এভাবেই একে একে জগতের সকল আদিতম সত্ত্বার আবির্ভাব ঘটে।
ইউরেনাস এ বিশ্বজগতের শাসনকর্তার দায়িত্ব নেয়। কিন্তু তার শাসনামল খুব একটা সুখের ছিলো না। সে সবসময় ভয়ে থাকতো হয়তো কোন একদিন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার সন্তানরা সিংহাসন দখল করে ফেলবে। তাই একসময় ইউরেনাস পৃথিবীর গভীরে অর্থাৎ গায়ার গর্ভাশয়ের ভিতর তার সন্তানদের বন্দী করে রেখে দেয়। এভাবে গর্ভাশয়ের ভিতর বন্দী করে রাখার কারণে গায়াকেও প্রচন্ড যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছিলো। ইউরেনাসের এসব কর্মকান্ড গায়াকে প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ করে তোলে। সে ইউরেনাসের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত নেয় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার। গায়া তার সন্তানদের কাছে যায় এ বিষয়ে সাহায্য নিতে। সন্তানদের মধ্যে কেবল ক্রোনাসই সাহস করে তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। ক্রোনাস ছিলো টাইটানদের মধ্যে সর্বকনিষ্ট। তথাপি সে ছিলো সবচেয়ে শক্তিশালী টাইটান। তারা দুজনে মিলে ইউরেনাসকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনামতো একদিন তারা ইউরেনাসের উপর হামলা চালায়। আচমকা এ হামলায় অপ্রস্তুত ইউরেনাস ক্রোনাসের সাথে পেরে উঠতে পারে না। ইউরেনাসকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এই বিশ্বব্রক্ষান্ডের নতুন শাসনকর্তা হিসেবে আবিভার্ব ঘটে টাইটান ক্রোনাসের।
ক্ষমতা দখলের পর ক্রোনাস তার ভাই সাইক্লপস আর হেরাটনচেরেসদের টারটারাসে (পাতালদেশ, পৃথিবীর নিচের জগত) বন্দী করে রেখে দেয়। ক্রোনাস এরপর তার সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয় আরেক টাইটান রেয়াকে। তাদের ঘরে জন্ম নেয় দুইজন দেবতা- হেডেস এবং পসাইডন ও তিনজন দেবী- হেরা, হেস্টিয়া এবং ডেমেটার।
কিন্তু ক্রোনাসকেও তার বাবার ভয়টা পেয়ে বসে। কারণ ইউরেনাস যাওয়ার আগে তাকে অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিলো ক্রোনাসের পরিণতি তার মতোই হবে। এজন্য ক্রোনাস আর তার সন্তানদের কোন জায়গায় বন্দী করে রাখার ঝুঁকি নেয়নি। সন্তানদের জন্মের পরপরই ক্রোনাস তাদের আস্ত গিলে ফেলতে শুরু করে। এভাবে ক্রোনাস একে একে তার পাঁচ সন্তানকেই গিলে ফেলে। রেয়ার আরেকটি সন্তান তখনও গর্ভে ছিলো। সে তার স্বামীর এ ধরণের কান্ড দেখে ভয় পেয়ে যায়। রেয়া সিদ্ধান্ত নেয় সেই সন্তানটিকে গোপনে জন্ম দেওয়ার। সে ক্রীট নামের একটা দ্বীপে চলে যায় সন্তান জন্ম দিতে। সেখানে এক পাহাড়ের পাদদেশে তার ষষ্ঠ সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় জিউস। জিউসের প্রতিপালনের ভার রেয়া নিম্ফ(গাছ)দের উপর ছেড়ে দেয়। সে এরপর একটা পাথরকে কাপড় দিয়ে ভালভাবে মুড়িয়ে সেটা ক্রোনাসের কাছে দেয়, বলে যে এটা তাদের ষষ্ঠ সন্তান। ক্রোনাস অতকিছু না দেখেই পাথরটা টুপ করে গিলে ফেলে।
এরপর অনেকগুলো বছর কেটে যায়। জিউস ততদিনে সাবালক হয়ে গেছে। জিউস তার বাবা সম্পর্কে জানতে পারে, জানতে পারে তার ভাইবোনদের পরিণতি। সে সিদ্ধান্ত নেয় এর একটা বিহীত করে ছাড়বে। কিন্তু সে একা আসলে কিছুই করতে পারবে না। একারণে জিউস মেটিস নামের এক টাইটানের শরণাপন্ন হয়। সব কথা শুনে মেটিস জিউসকে সাহায্য করতে রাজি হন। তিনি মদ ও সরিষার মিশ্রণে একটি পানীয় জিউসের হাতে ধরিয়ে দেন এবং বলেন এটা যেন সে যেকোন উপায়ে ক্রোনাসকে খাওয়ায়ে দেয়। জিউস এরপর একজন চাকরের বেশে ক্রোনাসের দরবারে উপস্থিত হয় এবং মিশ্রণটা ক্রোনাসের কাছে মদ বলে পরিবেশন করে। মিশ্রণটা খাওয়ার সাথে সাথে ক্রোনাসের বমি শুরু হয়ে যায়। এ বমির সাথে ক্রোনাসের খেয়ে ফেলা সন্তানেরা সব অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসে। এতদিন পেটের ভিতর থাকার পরও তাদের তেমন কোন ক্ষতি হয় নি। এমনকি পেটের ভিতরে থাকা সত্ত্বেও তারা ঠিকই বয়সের সাথে সাথে বেড়েও উঠছিলো। পেট থেকে সাবালক অবস্থাতেই তারা বেরিয়ে আসে। এরপর এই দেবতারা সবাই মিলে ক্রোনাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা ক্রোনাসকে পরাজিত করে তাকে টুকরো টুকরো করে কেটে টারটারাসে নিক্ষেপ করতে সক্ষম হন। স্বাভাবিকভাবেই বাকি টাইটানরা এ বিষয়টা চুপ করে মেনে নেয় নি। তারা দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ যুদ্ধে টাইটানদের দলের সেনাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় টাইটান এটলাসকে। আর অন্যদিকে দেবতাদের দলের নেতৃত্বের ভার নেন জিউস। শুরু হয় বিখ্যাত টাইটান বনাম দেবতাদের মহাযুদ্ধ।
দেবতারা হেরাটনচেরেস আর সাইক্লপসদের টারটারাস থেকে মুক্ত করে দেন। তারাও দেবতাদের পক্ষ নিয়ে এ যুদ্ধে অংশ নেয়। সাইক্লপসরা ছিলো সে যুগের সেরা কারিগর। তারা দেবতাদের জন্য অস্ত্র তৈরিতে নিযুক্ত হয়। তাদের হাতেই তৈরি হয় দেবতাদের বিখ্যাত মারণাস্ত্রগুলো, যেমন- জিউসের বজ্রাস্ত্র, পসাইডনের ত্রিশুল এবং হেডেসের অদৃশ্য হতে পারার শিরস্ত্রাণ। এসব অস্ত্রগুলো যুদ্ধের মোড় পাল্টে দিতে বিরাট ভূমিকা রাখে। এ যুদ্ধ টানা অনেক বছর ধরে চলতে থাকে। অবশেষে দীর্ঘ দশ বছর পর টাইটানরা এ যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে নেয়। বেশিরভাগ টাইটানকেই টারটারাসে বন্দী করা হয়। টাইটান সেনাপতি এটলাস বিশাল আকাশটাকে আজীবন কাঁধে বহন করে রাখার শাস্তি পান। এভাবেই অবশেষে এই বিশ্বব্রক্ষান্ডের দখল নিয়ে নেয় দেবতারা। এ মহাবিশ্বের নতুন শাসনকর্তা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন দেবরাজ জিউস।
[চলবে]